Kushana Period | Ancient Indian History
কুষাণ সাম্রাজ্যের বিস্তার ও কার্যকর ঘটনা
আগের পর্বে আমরা কুষাণ যুগের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ শাসকদের সম্পর্কে আলোচনা করেছি। এই পর্বে আমরা প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপর থেকে কুষাণ যুগের অর্থনৈতিক, সামাজিক, ধর্মজীবন, প্রসাশনিক, স্থাপত্য-ভাস্কার্য্য প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করবো।
সমাজ জীবন (Social Life) :
সে যুগের সমাজ জীবনের ছবি প্রতিফলিত হয়েছে সেই যুগের লেখা দু খানি গ্রন্থে মনুসংহিতায় ও অঙ্গ বিজ্জায়। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণ ও অনেক সংকর জাতের উল্লেখ আছে গ্রন্থ দু খানিতে। শংকর জাতির উদ্ভবের দুটি কারণ তিনি নির্দেশ করেছেন অসবর্ণ বিবাহ ও স্ববৃত্তি ত্যাগ। সমকালীন সমাজের দাস ও ক্রীতদাসদের সংখ্যা কম ছিল বলে মনে হয় না। দাস প্রথা ছিল ঠিকই তবু সেই যুগের কারখানা ও ক্ষেত প্রধানত দাস নির্ভর ছিল তা বলা যায়না। অনুলোম বা উচ্চবর্ণের পুরুষের সঙ্গে নিম্নবর্ণের কন্যার বিবাহ মনু অনুমোদন করেছেন। তিনি মনে করেন ঋতুমতী হওয়ার পূর্বে কন্যার বিবাহ দেওয়া উচিত। নারীদের সম্পর্কে বেশ কয়েকটি পরস্পর বিরোধী উক্তি করেছেন তিনি। বলেছেন যেখানে নারীদের সম্মান, সেখানে দেবতাদের অধিষ্ঠান। কুষান ও পল্লব রমনীদের সম্পর্কে বিবরণ দিয়ে গেছেন সেই যুগের এক লেখকের বার্ডেসানেস। এই দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করে, এ দেশের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে প্রভাবিত করে তারা ধীরে ধীরে ভারতীয় সমাজের অনুভূত হল । মনু জাতি সমূহকে একদিকে যেমন খস প্রভৃতি স্থান পেয়েছে তেমনি যবন, শক, চিনা প্রভৃতি নানা প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মনুসংহিতায় কৃষি পশুপালন ও ব্যবসার সাথে নিজের উন্নতির ফলে সামাজিক সংহতি প্রতি পত্তি বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেছেন।
অর্থনৈতিক অবস্থা (Economy) :
কুষাণ যুগে ভূমি ছিল ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। সমকালীন লেখে জলাশয় ও খাল খননের উল্লেখ পাওয়া যায়। বাড়ি হোক তাতে স্থানীয় অঞ্চলের জলের প্রয়োজন মেটে কিন্তু বৃহত্তর অঞ্চলের জলের প্রয়োজন মিটে না। জল সংরক্ষণ ও সরবরাহের কাজে সে যুগের কারিগরি দক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায় এলাহাবাদের নিকটবর্তী চতুর্থ পর্বে নির্মিত এক বৃহৎ প্রকল্প নিদর্শনে। মনু সেচ প্রকল্পের গুরুত্ব সম্পর্কে যথাযথ সচেতন ছিলেন | সমকালীন লেখে ও সাহিত্যে সে যুগের উৎপন্ন কয়েকটি ফসলের উল্লেখ আছে। কৃষিজ পণ্যের মধ্যে ব্রীহি, শালিধান, মাষ এবং ইখুর উল্লেখ আছে মনুসংহিতায়। কুশান পর্বে শুধু কৃষির ক্ষেত্রে নয় কারিগরি শিল্পের ক্ষেত্রে অগ্রগতি ঘটে ছিল তক্ষশীলা, কৌশাম্বী, সাচী প্রভৃতি স্থানে। সেই যুগের লোহাশিল্পের প্রচুর নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। সেই সময়ের এক প্রধান শিল্প তক্ষন শিল্প। এই সময়ের অপর একটি শিল্প ছিল বস্ত্রশিল্প। এছাড়াও স্বর্ণকার ও মনিকারদের উল্লেখ আছে।
কৃষি ও কারিগরি শিল্প যেমন অগ্রগতি ঘটেছিল, তেমনই উন্নতি ঘটেছিল ব্যবসা–বাণিজ্যের ক্ষেত্রে। কুশান যুগে এই বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির পেছনে যে কারণগুলো নিহিত ছিল তা অনুধাবনযোগ্য। কুষাণদের সময় মধ্য এশিয়া থেকে উত্তর ভারতের অখন্ড রাষ্ট্রীয় রূপে আত্মপ্রকাশ করে। কুষাণ যুগের বাণিজ্যের বিশেষ করে বহির্বাণিজ্যের সম্প্রসারনের আরো কারণ ছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে কুষাণ সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণের পেছনে যে কারণটি ছিল তা হল আন্তর্জাতিক “রেশম পথ” (Silk Route) যা বাণিজ্য উপলক্ষে ব্যবহৃত হত সেটি ছিল যেমন দুর্গম ও সমস্যাসঙ্কুল।
রোমের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে কুশান রাজারা আগ্রহী ছিলেন। রাজ্যের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ করার উদ্দেশ্যে তারা রোমে প্রতিনিধি প্রেরণ করেছিলেন। দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে ভারতের যে ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তা আজ পরিলিখিত। বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনে আন্তরিকতার পরিচয় দিয়েছেন তারা, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার ক্ষেত্রে অনাগ্রহী হবেন না বোধহয়। প্রাচীনকালে বিখ্যাত বন্দর তাম্রলিপ্তি বাংলার মেদিনীপুর জেলায় অবস্থিত ছিল। টলেমি যে টামেলেটিস বন্দরের কথা বলেছেন তা এই তাম্রলিপ্তি।
কুশান পর্বের আর্থিক সমৃদ্ধির প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়েছে সে যুগের মুদ্রার প্রাচুর্যে ।রাজ্যের সর্বত্র একই ধরনের পরিমাপ এর মুদ্রার প্রচলন ছিল বলে মনে হয় না। এই পর্বে কখনো অধিক সংখ্যার মুদ্রা উৎকীর্ণ হয়নি। সোনা, রুপা ও তামা এই তিন ধাতুতে মুদ্রা কুশান রা প্রস্তুত করেন। স্বর্ণমুদ্রা গুলি তৈরি হয়েছিল যা শুধু কুষাণ সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে পাওয়া যায়নি সাম্রাজ্যের বাইরে এমনকি দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া আবিষ্কৃত হয়েছে।
ধর্মীয় জীবন (Religious Believes) :
ভারতীয় ধর্মের ইতিহাসে বিশেষত বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষেত্রে কুষাণ যুগের গুরুত্ব অপরিসীম। ধর্মকে কেন্দ্র করে যে কয়েকটি দলের ও উপদলের সৃষ্টি হয়েছিল তা ইতিপূর্বেই লক্ষ্য করা গেছে। চীনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাঙ ধর্মের তাৎপর্য ব্যাখ্যা নিয়ে বিভিন্ন বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্যের উল্লেখ করেছেন। কুষাণ যুগের শ্রেষ্ঠ মহাজনী দার্শনিক নাগার্জুন। কুশান আমলে উত্তর ভারতের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ ধর্মাবলম্বী ছিল তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই ধর্মের জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও অন্যান্য ধর্মের বিকাশ অব্যাহত হতে থাকে এ সময়। এই সময়ে বাসুদেব উপাসকদের এক গোষ্ঠী এক অভিনব দৃষ্টিকোণ ও রীতিতে বৃষ্ণবীর পূজার প্রচলন করেন। দেখা যাচ্ছে পঞ্চরাজ্য বহুবিধ এর মধ্য দিয়ে বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য ব্যাখ্যা করেছে। এই পর্বের কোন বাসুদেব নিদর্শন পাওয়া যায়নি।
কুষাণ যুগের ভাগবত ধর্ম তার আঞ্চলিকতার পরিচয় ছাপিয়ে উঠতে পারেনি। ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে এর প্রভাব সীমাবদ্ধ থাকে। মথুরা অঞ্চলে যথেষ্ট প্রভাব ছিল। মধ্যপ্রদেশের বিদিশা ও উত্তরপ্রদেশের অত্র অঞ্চলের প্রতিষ্ঠা ছিল। ভাগবত ধর্ম সম্ভবত এই পর্বে উত্তর বাংলায় বিস্তার লাভ করেছিল। বিম কদফিসেস, প্রথম কনিষ্ক প্রভৃতি কুশান রাজগণের মুদ্রায় শিবের মূর্তি রয়েছে । শিব কখনো নিঃসঙ্গ আবার কখনো পত্নী ও সহচরীর সঙ্গে। এসময়ে এক নতুন সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয় পশুপাত নামে।এই সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের প্রথমদিকে গুজরাতে জন্মগ্রহণ করেন।
এছাড়াও কুশান মুঠোয় যুগে সূর্যমূর্তি উৎকীর্ণ রয়েছে । এই সময় নির্মিত এক বিরাটাকায় নাগ মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এছাড়াও দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভান্ডারকর মনে করেন কুষাণ যুগে লিঙ্গ পূজার প্রচলন ছিল। শিবের লিঙ্গ রূপে পূজা সে যুগের কুশান আমলে প্রচলিত ছিল। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতকে এক পাথরের লিঙ্গ অন্ধ্রপ্রদেশে আবিষ্কৃত হয়েছে।
স্থাপত্য ও ভাস্কর্য :
বর্তমান পেশোযার শাহ্–জী–কী চেরিতে বুদ্ধের দেহাবশেষ এর উপর কনিষ্ক যে সুউচ্চ মিনার নির্মাণ করেছিলেন সেটি নিঃসন্দেহে কুষাণ যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকীর্তি। উত্তরপ্রদেশের মাহির ও আফগানিস্তানে কুষাণ যুগের দুটি দেবকুলে সন্ধান পাওয়া গেছে। কনিষ্কের সমকালীন জৈনিক স্থপতি এগসিলাস । তিনি তক্ষশীলার কাছে একটি বৌদ্ধ স্তুপ নির্মাণ করেন।
স্থাপত্যের তুলনায় কুষাণ যুগের ভাস্কর্যের নিদর্শন প্রচুর। আফগানিস্তান ও পাঞ্জাব জুরে বৃহত্তম থোরা অঞ্চলে কুশান ভাস্কর্যের পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। বুদ্ধ –বোধিসত্ত্বের মূর্তি গঠনে গান্ধার শিল্প রীতি অনুসরণ করেছেন। মথুরার ভাস্কর্যে দেশীয় শিল্প রীতি প্রাধান্য পেয়েছে। মথুরার ভাস্কর্যে গান্ধার শিল্পরীতি প্রভাব যে একেবারে পড়েনি তা নয়। মথুরায় পাওয়া কুষাণ যুগের যক্ষ–যক্ষিণী মূর্তি গুলির কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়। গান্ধার ও মথুরার মথুরা শিল্পর আরেক উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র আফগানিস্তানের বাল্লিক।পোড়া মাটি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন শ্রেণীর মানুষের মধ্যে পাটনা, মথুরায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গেছে।
ভাষা ও সাহিত্য :
বর্তমানে কবিতার আকারে মনুর নামে যে গ্রন্থখানি পাওয়া যায় সেই মনুসংহিতা সম্ভবত কুশান পর্বেই রচনা। ধর্ম শাস্ত্র কার মনু কুষাণ যুগের পূর্বে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং সূত্রের আকারে এককালীন গ্রন্থ লেখেন। এই গ্রন্থে দাবি করা হয়েছে সর্বজ্ঞ মনু ধর্ম সম্পর্কে যা বলেছেন বেদে তার সমর্থন আছে। এ যুগের এক বিখ্যাত সাহিত্য–সমালোচক ভরত। চরক কুষাণ রাজ প্রথম কনিষ্কের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন এরূপ একটি ধারণা প্রচলিত আছে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের উপর তিনি এক সংহিতা রচনা করেন। জৈন অঙ্গ ও উপাঙ্গের ওপর ছন্দে লেখা নিযুক্তি গুলি কুষাণ যুগের রচনা বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। এ যুগের বিখ্যাত সাহিত্যিক অশ্বঘোষ।
উপসংহার :
ভারতের ইতিহাসে কুষাণ যুগ বিশেষভাবে স্মরণীয়। এ সময় ভারতের সঙ্গে একদিকে মধ্য এশিয়া ও চীন এবং অন্যদিকে পশ্চিম এশিয়া ও রোমান সাম্রাজ্যের নিবিড় যোগসূত্র স্থাপিত হয়। ফলে ব্যবসা বাণিজ্য উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির পরিপুষ্ট সাধন হয়। কুশান রা বিজয়ীর বেশে ভিনদেশ হতে ভারতে এসেছিলেন। অতি অল্প দিনের মধ্যেই এদেশকে তারা আপন করে নেন। নিজেদের স্বতন্ত্র বিসর্জন দিয়ে, এদেশে ধর্ম ও সাংস্কৃতিকে আশ্রয় করে তারা ভারতের মহামানবের মহাসাগরে বিলীন হয়ে যান।
👉 PART 1