Cause and Effect of Peasant Revolt In British India
কৃষক বিদ্রোহ ও তার প্রভাব
কৃষক বিদ্রোহ (Peasant Revolt) :
নিম্নবর্গের আন্দোলনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য হলো কৃষক বিদ্রোহ। এদের ব্যাপ্তি ছিল সীমিত ও খণ্ডিত। অর্থাৎ এদের কোন সর্বভারতীয় চরিত্র ছিল না। ইংরেজ আমলে ভারতের সর্বত্র অসংখ্য কৃষক বিদ্রোহ ঘটনা ঘটেছিল। চীনের তুলনায় ভারতের কৃষক বিদ্রোহ গুলির ভৌগলিক চৌহদ্দি ছিল অনেক ছোট। বিভিন্ন অঞ্চলের কৃষকদের মধ্যে পারস্পরিক যোগাযোগ তেমন ছিল না। তাছাড়াও ভাষা ও সংস্কৃতিগত পার্থক্য ছিল। ইংরেজরা 100 বছর ধরে একটু একটু করে ভারতে তাদের সাম্রাজ্যর স্থাপন করেছিল। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন সময়ে কৃষক বিদ্রোহ ঘটেছিল। সেই সময় ইংরেজ শাসন অনেক বেশি সুসংহত ও শক্তিশালী ছিল।
কৃষক বিদ্রোহের প্রকৃতি (Nature of Peasant Revolt) :
কৃষক বিদ্রোহের চরিত্র, বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি প্রসঙ্গে ঐতিহাসিকদের কৌতূহলের শেষ নেই। এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। স্বাভাবিক কারণেই তাই নানা বিতর্কের অবকাশ আছে। প্রথমত কৃষক বিদ্রোহ গুলিকে বিশ্লেষণ করতে হবে, কৃষকদের নিজস্ব কাঠামো ও সংগঠনের পরিপ্রেক্ষিতে। বিদ্রোহ গুলির মধ্যে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছিল, কৃষকদের মানসিকতা চেতনার নানা স্তর অতিক্রম করে এবং একটা সুস্পষ্ট লক্ষ্য স্থির করে তবেই কৃষকেরা বিদ্রোহ কে বেছে নেয় তাদের শেষ অস্ত্র হিসাবে।
ক্যাথলিন গাফ ভারতের কৃষক বিদ্রোহ গুলোকে মোটামুটি পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করেছেন- i) পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন যার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল ইংরেজদের ভারত থেকে বিতাড়িত করে আগের আগের মুল শাসক কে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা। ii) ধর্মাশ্রয়ী আন্দোলন, iii) সামাজিক দস্যুতা, iv) সন্ত্রাসবাদি প্রতিহিংসামূলক আন্দোলন এবং v) কোন বিশেষ অভাব বা অভিযোগের প্রতিকার করার উদ্দেশ্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ।
এ ধরনের আন্দোলনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল কোন অভাব অভিযোগ বা অসন্তোষের প্রতিকার এবং প্রথমদিকে শান্তিপূর্ণ পথেই আন্দোলন শুরু হয়েছিল। কিন্তু পরে প্রতিপক্ষ কোন প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে আন্দোলন হিংসার রূপ নিয়েছিল।উনিশ শতকের সমস্ত কৃষক বিদ্রোহের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়ার কোনো অবকাশ নেই। তাই আমরা নিচে কয়েকটি মাত্র বিদ্রোহের কথা আলোচনা করলাম।
নীল বিদ্রোহ (1859-61) :
ইংরেজ রাজত্বে যেসব কৃষক বিদ্রোহী হয়েছিলেন তার মধ্যে নীল বিদ্রোহ নানা কারণে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। এই বিদ্রোহের এমন কয়েকটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য ছিল এই বিদ্রোহকে অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহ থেকে কিছুটা পৃথক করেছে। এই বিদ্রোহ জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে কোন আন্দোলন নয়। নীলকুঠি সাহেবরা ছিল কৃষকদের প্রতিপক্ষ। তাদের অকথ্য অত্যাচার ও জোর-জবরদস্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল এই আন্দোলন। কিন্তু এই বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল অনেক প্রসারিত। কৃষকরা শুধু জোরজবস্তি নীলচাষ বন্ধ করতে চায়নি, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল সমস্ত নীলচাষ পুরোপুরি অবলুপ্তি। এই ধরনের বিপ্লবীক কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলন এর আগে কোনদিন ঘটে।
এই আন্দোলনের ক্ষেত্রে কৃষকরা মানসিক চেতনা ও তার বিরল দৃষ্টান্ত রেখেছিল তার তুলনা হয়না। তারা দৃঢ় প্রত্যয় এর সঙ্গে জানিয়েছিল যে, তারা নীল চাষ করবে না। নীল কমিশনের পক্ষ থেকে কৃষকদের এই মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায়। অন্যান্য কৃষক বিদ্রোহের ক্ষেত্রে সরকার যে ধরনের সরকার যে ধরনের কৃষক বিরোধী মনোভাব গ্রহণ করেছিল ও বিদ্রোহ দমন করতে তৎপর ও সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিল, এক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম ঘটেছিল। নীল বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মানুষ যোগ দিয়েছিল। শুধু কৃষকরাই নয়, এই বিদ্রোহের শামিল হয়েছিল কিছু জমিদার ব্যবসায়ী তালুকদার পত্তনিদার।
নীল বিদ্রোহের প্রভাব (Effect) :
নীল বিদ্রোহ সেই সময়ে বাঙালি সমাজে যে চাঞ্চল্য আলোড়নের সৃষ্টি করেছিল তা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের সাধারণভাবে কৃষকদের দুঃখ-দুর্দশা নিয়ে খুব একটা ভাবনাচিন্তা না করলেও নীলচাষীদের সম্পর্কে তাদের সহানুভূতি ছিল। ১৮১৯ সালে অক্ষয় কুমার দত্ত “তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা” এবং ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত “প্রভাকর” পত্রিকার নীল বিদ্রোহ নিয়ে লেখালেখি করেছিলেন। নীল বিদ্রোহের সঙ্গে সঙ্গেই বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়ে হাজির হয়। এই প্রসঙ্গে হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও তাঁর সম্পাদিত হিন্দু পেট্রিয়ট পত্রিকায় একথা সহজেই জানা যায়। দীনবন্ধু মিত্রের “নীলদর্পণ” নাটক লিখে কিভাবে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিলেন এবং এই নাটকের ইংরেজি অনুবাদ জেমস লং এর নামে প্রকাশিত হয়। যেসব নাটকীয় ঘটনা ঘটেছিল তাও প্রত্যেক বাঙালির জানা।
পাবনার কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭৩) :
পাবনার কৃষক বিদ্রোহের কারণ, চরিত্র ও প্রকৃতি প্রভৃতি প্রশ্ন কে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ আছে। তবে পাবনা বিদ্রোহ যে জমিদার বিরোধী এবং এই বিদ্রোহ যে মূলত সম্পন্ন ও কৃষক শ্রেণীর বিদ্রোহ তাদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। পাবনা বিদ্রোহের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই জমিদার শ্রেণীর শোষণ ও অত্যাচারের কথা উল্লেখ করেছেন। এই অত্যাচারের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো যথেচ্ছ কর বৃদ্ধি। খাজনা বৃদ্ধির হার ছিল আত্যাধিক বেশি। মূল করের সঙ্গে অবৈধ্য আবওয়াব যুক্ত হওয়ায় কৃষকদের পক্ষে এই বোঝা দুর্বহ বলে মনে হতো। এইভাবে নানা অজুহাতে কৃষকদের কাছ থেকে যে বাড়তি অর্থ আদায় করা হতো। সেই বাড়তি করের বোঝা কৃষকরা দিতে অস্বীকার করে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় সূত্র থেকেই আমরা জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের ব্যাপক ক্ষোভ ও অসন্তোষ এর কথা জানতে পারি।
মহারাষ্ট্রের কৃষক বিদ্রোহ (১৮৭৫) :
উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যেসব কৃষক বিদ্রোহ হয়েছিল, তার মধ্যে মহারাষ্ট্রের কৃষক বিদ্রোহ সরকারি পরিভাষায় যাকে দক্ষিণাত্য হাঙ্গামা বলা হয়েছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহারাষ্ট্রের কৃষক বিদ্রোহ ছিল ভারতের কৃষি অর্থনীতিতে আর এক শোষক গোষ্ঠী মহাজনদের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা আন্দোলন। কেন এই বিদ্রোহ হয়েছিল, কি ছিল তার প্রকৃত কারন, বিভিন্ন প্রশ্ন কে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিকদের কৌতূহল ও অনুসন্ধান অন্ত নেই।
মহারাষ্ট্রের কৃষক অসন্তোষ এর মূল কারণ ছিল রায়তওয়ারি ব্যবস্থায় কৃষকদের উপর অতিরিক্ত করের বোঝা। খাজনার অত্যাধিক হারের জন্য অনেকাংশে দায়ী ছিল কৃষকদের খাজনা দেওয়ার ক্ষমতা সম্পর্কে সরকারের ভ্রান্ত ধারণা। মহারাষ্ট্রের অনুর্বর ভূমিতে পর্যাপ্ত শস্য উৎপন্ন হতো না ও অনাবৃষ্টির আশঙ্কা ছিল সব সময়। কিন্তু দুর্ভিক্ষ, বাজার দামের ওঠা পড়ার জন্য খাজনার কোন হেরফের হতো না। ফলে কৃষকদের দুর্দশার অন্ত ছিল না। এই অবস্থায় কৃষকদের পক্ষে মহাজনের কাছে হাত পাতা ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা ছিলো না। কৃষকদের মহাজনের কাছে ঋণ করতে বাধ্য হতে হয়েছিল খাজনা মেটানোর দাবিতে। কিন্তু মহাজনদের কাছে একবার জমি বন্ধক রেখে ঋণ করলে সেই জমি ফেরত পাওয়া আর সম্ভব ছিল না। এইসব বিভিন্ন কারণে মহারাষ্ট্রের কৃষকদের মধ্যে অসন্তোষ ও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। এর ফলে তারা কোনো উপায় না দেখে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।
মহারাষ্ট্রের কৃষক বিদ্রোহ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়নি। মহারাষ্ট্র বিদ্রোহ ও ফারকের কার্যকলাপের ফলে সরকার বুঝতে পেরেছিল যে কৃষকদের ন্যায্য দাবিগুলো পুরোপুরি অগ্রাহ্য করা সম্ভব নয়। এর ফলে মহাজনদের সুদের কারবার কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয় এবং কৃষকদের জমি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে কিছুটা বাধা।