Ancient Indian History | Satbahan Period
সাতবাহন রাজবংশ (Satbahan Dynasty) :
উড়িষ্যায় যখন চেদি রাজবংশের পতন ঘটেছিল, তখন মহারাষ্ট্রে এক নতুন রাজবংশের উদ্ভূত হয়। ইতিহাসে এই রাজবংশ সাতবাহন রাজবংশ নামে প্রসিদ্ধ। এই বংশের রাজারা পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে এক শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক শক্তি রূপে আবির্ভূত হন। সাতবাহন পদটি মুন্ডা ‘সাদাম’ এবং ‘হপন’ হতে নিষ্পন্ন বলে অনেকে অভিমত প্রকাশ করেছেন। সাদাম এর অর্থ ঘোড়া, হপন এর অর্থ পুত্র। তারা মনে করেন অশ্বমেধ যোগ্য যিনি অনুষ্ঠান করেছেন, তাঁর পুত্র এই অর্থে সাতবাহন।
আদি নিবাস :
অন্ধ্র বনাম মহারাষ্ট্র : পুরাণাদি গ্রন্থের সাতবাহন রাজাদের অন্ধ্র রাজতন্ত্রের এক অন্তবৃত্ত আখ্যা দেওয়া হয়েছে। অশোকের লেখমালায় অন্ধ্রকে মৌর্য সাম্রাজ্যের অংশরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। সাতবাহন রাজাদের প্রথম পর্বের কয়েকখানি লেখ মহারাষ্ট্রে পাওয়া গেছে। এই বংশের আদি রাজা শিমুকের পূত্রবধূ পশ্চিমঘাট পর্বতমালার গিরিপথ এর কাছে একখানি উল্লেখ করেছিলেন। অজয় মিত্র শাস্ত্রী মনে করেন, সাতবাহন রাজারা প্রথমে অন্ধ্রপ্রদেশে রাজত্ব করতেন কিন্তু পরে তারা মহারাষ্ট্রে আধিপত্য বিস্তার করেন।
প্রতিষ্ঠাকাল :
সাতবাহন রাজারা ঠিক কত দিন রাজত্ব করেছে তা নিয়ে পন্ডিত মহলে মতবিরোধ আছে। সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সিমুক রাজা সুশর্মা কে পরাজিত করেছিলেন এ কথা প্রায় সব পুরানে বলা হয়েছে। নেভাসায় আদি ঐতিহাসিক পর্বগুলি সময়রেখা নির্মিত হয়েছে তা নিঃসন্দেহে বিতর্কিত ত্রুটিপূর্ণ। নেভাসায় উৎখননে প্রাপ্ত একটি তথ্য সাতবাহন রাজাদের এই প্রাচীন ভারতের বিপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। সাতবাহন পর্ব আবিষ্কৃত হয়েছে চতুর্থ পর্বের উচ্চতম ভূস্বর্গ। প্রথম শতকের শেষার্ধে সাতবাহন পর্বে শুরু হয়।
রাজ বৃত্তান্ত :
সাতবাহন রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা সিমুক। কালক্রমে সম্ভবত মহারাষ্ট্রের তিনি এক স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। শেষ জীবনে সিমুক স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠায় পরিণামে তাকে সিংহাসন ও প্রাণ হারাতে হয়।
প্রথম সাতকর্ণী : সাতবাহন রাজ বংশের তৃতীয় রাজা প্রথম সাতকর্ণী। পুরাণে তাকে কৃষ্ণের পুত্র বলা হয়েছে। প্রথম সাতকর্ণীর রাজত্বকালে সাতবাহন রাজবংশের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। প্রথম সাতকর্ণী সময় পূর্ব উপকূলবর্তী কলিঙ্গ রাজ্য টি পরআক্রান্ত হয়ে ওঠে। চেদিবংশীয় খারবেল তখন কলিঙ্গের অধিপতি। লেখে প্রথম সাতকর্ণী কে দক্ষিণাপথপতি ও অপ্রতিহতচক্র রূপে বর্ণনা করা হয়েছে।
সাতবাহন শক্তি পুনরুত্থান :
গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী : নহপানের ক্ষত্রপ পদে অভিষিক্ত হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী সাতবাহন সিংহাসনে আরোহন করেন। ইতিহাসে গৌতমীপুত্র সর্বশ্রেষ্ঠ সাতবাহন রাজা রূপে স্বীকৃত। নহপানের বিরুদ্ধে জয়লাভ তার একমাত্র কৃতিত্ব নয়। তিনি শক, যবন ও পল্লবদের সংহার করেছেন বলে নাসিক প্রশস্তিতে দাবি করা হয়েছে। জুনাগর লেখে সাতকর্ণী সঙ্গে রুদ্র দামার ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের উল্লেখ আছে। গৌতমীপুত্র সম্পর্কে কিছু ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। অনেকের বিশ্বাস করতেন গৌতমীপুত্র প্রখ্যাত দার্শনিক নাগার্জুনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
অন্যান্য রাজন্যবর্গ : গৌতমীপুত্রের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র পুলুমাবি আনুমানিক ১৩০ খ্রিস্টাব্দে রাজপদে অভিষিক্ত হন। কৃষ্ণা নদীর দক্ষিণের রাজ্য বিস্তার পুলুমাবির উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব। এছাড়াও পরবর্তীতে শিবস্কন্দ সাতকর্ণী এবং জগ্যশ্রী সাতকর্ণী যথাক্রমে সিংহাসন আরোহন করেন। পুরানে শিব স্কন্দ সাতকর্ণী অমরাবতী লেখের শিব স্কন্দ সাতকর্ণী এবং মুদ্রায় স্কন্দ সাতকর্ণী সম্ভবত এক ও অভিন্ন ব্যক্তি। যোগ্যশ্রী সম্ভবত বুদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মধ্যপ্রদেশের পূর্বাঞ্চল সম্ভবত যোগ্যশ্রীর রাজ্য ভুক্ত ছিল।
প্রশাসনিক ব্যবস্থা (Administration System) :
প্রশাসনের শীর্ষে ছিলেন রাজা। জনকল্যাণকর কাজে রাজার ঐকান্তিক আগ্রহ ছিল। সাতবাহন রাজ্যে দু’রকম শাসন ব্যবস্থা চলছে। এছাড়া লেখে মহামাত্র, কেরনিক, লেখক, দুতক, রাজামাত্র প্রভৃতি রাজকর্মচারী কথা বলা হয়েছে। রাজার বিশেষ আস্থাভাজন এবং উপদেষ্টার একজন ছিলেন রাজামাত্র। সমকালীন একখানি লেখে মহা-তলবর এর উল্লেখ আছে, এর অর্থ প্রহরী। রাজার প্রত্যক্ষ শাসনাধীন অঞ্চল আবার অনেকগুলি আহারে বিভক্ত ছিল। অনেকগুলি গ্রাম নিয়ে ছিল একটি আহার।
সামাজিক জীবন (Social Life) :
সে যুগের সামাজিক জীবনের কিছু ছবি ধরা পড়েছে সমকালীন লেখে, সাহিত্যিক উপাদান এবং ভাস্কর্যে। সমাজে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা চালু ছিল ঠিকই কিন্তু এর ভিত বেশ দুর্বল ছিল। যৌথ পরিবার তখনকার সমাজের এক উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। অমরাবতী ও কার্লর ভাস্কর্যে সে যুগের বসনভূষণের পরিচয় মেলে। নাসিক প্রশস্তি হতে জানা যায় মহিষী নয়নিকা বৈদিক যাগযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছেন। এই সময় অশিক্ষিত হওয়ায় মহিলাদের যাগযজ্ঞের অধিকার ছিল না। বৈদিক মন্ত্র উচ্চারণ মেয়েদের পক্ষে নিষিদ্ধ ছিল । মনুর বিধান ও অনুশাসন সাতবাহন রাজ্যের জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
অর্থনৈতিক ব্যবস্থা (Economy) :
সাধারণ লোকের আয় মূল উৎস ছিল কৃষি। লেখমালায় গো-দান ও ভূমিদানের অজস্র উল্লেখ জনজীবনে কৃষির গুরুত্ব আভাসিত করে। মিলিন্দ পঞ্হে কঙ্কন উপকূল অঞ্চলের প্রধানের উল্লেখ আছে। কৃষিকাজে এই পর্বে দুটি বিশেষ ধরনের যন্ত্রের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। উদক যন্ত্র ও অরহত ঘটিকার ব্যবহারের ফলে কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। সাতবাহন রাজ্যে জমির ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠা ছিল। সে সময় ধর্ম ছাড়া অন্য কোন কারণে জমির কেনাবেচা হতো না। সম্ভবত উৎপন্ন ফসলের এক ষষ্ঠতাংশ রাজস্ব ব্যবস্থার জমা হত। লেখে এই যুগের বিভিন্ন বৃত্তি ও কারিগরি শিল্পের উল্লেখ পাওয়া যায়।
এই যুগে অনেকেই ধাতু, পাথর এবং মৃৎশিল্পকে জীবিকা রূপে গ্রহণ করেছিলেন। সাতবাহন রাজারা সিসা, তামা, রুপা ও মিশ্র ধাতুতে অনেক মুদ্রা উৎকীর্ণ করেছেন। সাতবাহন রাজ্যের সঙ্গে বাইরের দেশের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে, দক্ষিণ ভারত থেকে যেমন চাল গমের মতো খাদ্যশস্য পূর্ব আফ্রিকার রপ্তানি হতো তেমনই গোলমরিচ, দারুচিনির ,মশলাপাতি ইত্যাদি সৌখিন দ্রব্যাদি ও রপ্তানি হতো। রোমের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক লেনদেনের লাভের পাল্লাটা ভারতের দিকে ঢোকানো ছিল। শকদের সঙ্গে সাতবাহন রাজাদের সংঘর্ষ ভারত রোম বাণিজ্যের ক্ষেত্রে শুভ হয়নি। শঙ্গম সাহিত্যের বহিবাণিজ্য সম্পর্কে কিছু মূল্যবান তথ্য পরিবেশিত হয়েছে। দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের সঙ্গে সঙ্গে সে অঞ্চলের ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রসার লাভ করে।
ধর্মীয় জীবন (Religion) :
সাতবাহন রাজারা ব্রাহ্মণধর্মাবলম্বী ছিলেন। সমাজে বিশেষ করে অভিজাত মহলে বৈদিক যাগযজ্ঞ যেমন সমাদার লাভ করেছিল, তেমনি বাসুদেব এবং পশুপতির মতো পৌরাণিক দেবতারাও জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্র প্রদেশের নানা স্থানে প্রাচীন নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এসময় মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্রপ্রদেশে বৌদ্ধধর্ম ব্যাপকভাবে প্রসার লাভ করে। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের নাগার্জুনের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ‘মহাযান’ ধর্মমত ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। মধ্যমপন্থা কে নির্দেশ করে বলে নাগার্জুনের মতবাদকে মাধ্যমিক মতবাদ বলা হয়। গাঁথাসপ্তসতীতে বুদ্ধের পদ উপাসনার উল্লেখ আছে। বৌদ্ধ ধর্মের কিছু কিছু বিষয় বস্তুকে কেন্দ্র করে বিক্ষোভ ও মতবিরোধ বিভিন্ন সম্প্রদায় ও উপ সম্প্রদায়ের উদ্ভব ইতিপূর্বে সবিস্তারে আলোচিত হয়েছে।
ভাষা ও সাহিত্য (Literature) :
ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাসে সাতবাহন যুগ এক স্মরণীয় অধ্যায়ে রূপে চিহ্নিত। এ সময় কার লেখা গ্রন্থ কাতন্ত্র ও বৃহৎকথা। প্রথম খানি সংস্কৃতি লেখা, লেখক সর্ববর্মা। দ্বিতীয় খানি পৈশাচী প্রাকৃত লেখা রচয়িতা গুনাধ্য। এছাড়াও আরো কিছু উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকীর্তি হলেও গাঁথা সপ্তসতী ও লীলাবতী পরিণয়। শুধু প্রাকৃত নয়, সংস্কৃত সাহিত্য চর্চা তেও এ সময় যথেষ্ট অগ্রগতি হয়। সাতবাহন যুগের প্রাকৃত সাহিত্যচর্চার আরেকটি নিদর্শন সেযুগের লেখ। এই যুগের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক-সাহিত্যিক নাগার্জুন।
স্থাপত্য-ভাস্কর্য :
অমরাবতী , ঘন্টকশাল, নাগার্জুনকোন্ডা প্রভৃতি স্থানে এ যুগে বেশ কয়েকটি স্তূপ নির্মিত হয়। পশ্চিমঘাট পর্বতমালার গা কেটে সাতবাহন যুগের বেশ কয়েকটি চৈতয় গৃহ নির্মিত হয়। নাসিকের তুলনায় অনেক সুন্দর উন্নত এই যুগে কয়েকটি নির্মাণ। কেরলাতে পাহাড় কেটে কয়েকটি বিহার নির্মিত হয়। ভাজা, নাসির কারলাতে চৈত্র গৃহের এবং অমরাবতী নাগার্জুনকোন্ডা প্রভৃতি স্থানে এই যুগের শিল্পীরা তাদের অবিনশ্বর ভাস্কর্যটির স্বাক্ষর রেখেছেন। ঈষৎ সবুজ চুনা পাথরের খোদিত অমরাবতী ভাস্কর্যে আছে বিষয়-বৈচিত্র্য। খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতকের ভাস্কর্যে ধরা পড়েছে শিল্পীর রুচি ও অনুভূতির পরিপূর্ণ বিকাশ।সাতবাহন রাজাদের রাজত্বকাল দক্ষিণ ভারতের ইতিহাসে অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।